ছবি: সংগৃহীত
১৫ পেরিয়ে ১৬ বছরে পা রাখছে উত্তরবঙ্গের আলোকবর্তিকা রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)। উত্তর অঞ্চলের এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল ৩০০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে রংপুর সদরের ধাপ এলাকায় সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রাঙ্গণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদ, ২২টি বিভাগ, একটি ইনস্টিটিউট রয়েছে। অধ্যয়ন করছেন প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী। রয়েছেন প্রায় ১৯৬ জন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য রয়েছে মোট চারটি আবাসিক হল (ছেলেদের দুটি, মেয়েদের দুটি)। মেয়েদের জন্য আরেকটি হল নির্মাণাধীন।
বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাসহ প্রথম শ্রেণির চাকরিতে নিয়োজিত আছেন। গত ১৬ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৈরি হওয়া বহু কীর্তিমান শিক্ষার্থী দেশ-বিদেশে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন। এছাড়া এখানকার শিক্ষকরা জাতীয় পরিবেশ পদক সম্মাননাসহ গবেষণায় অসামান্য অবদান রেখে চলছেন। পরপর দুইবার বিশ্বসেরা ২% বিজ্ঞানী তালিকায় নিজেদের উপস্থাপন করেছেন। এভাবে গবেষণা ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নিজ নিজ ক্ষেত্রে রেখে যাচ্ছেন অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। উপাচার্যের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সেশনজট এখন নেমেছে শূন্যের কোঠায়।
এতে পিছিয়ে নেই শিক্ষার্থীরাও। এখানকার শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর ক্রমান্বয়ে রেখে চলছেন। অনেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরের দেশে পড়তে যাচ্ছেন। তারা দেশের সম্মান ও ভাবমূর্তি বিশ্বের কাছের সুন্দরভাবে উপস্থাপনের সুযোগ পাচ্ছেন।
সেশনজট নিরসন ছাড়া বেরোবির অর্জনে বলার মতো এখনো তেমন গল্প ও দৃষ্টান্ত নেই। তবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে হলে, দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের গৌরবময় অবস্থানে রাখতে হলে চলমান সমস্যা ও সংকটগুলোর সমাধান করতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষক সংকট, শ্রেণিকক্ষ স্বল্পতা বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে বিদ্যমান। এর সমাধান এখনো হয়নি। এছাড়া রয়েছে চরম আকারে শিক্ষক রাজনীতি। উত্তর জনপদের আশা-ভরসার প্রতীক এই ক্যাম্পাস হলেও পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা না থাকায় বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) মোট শিক্ষার্থীর ৮৮ শতাংশের নেই কোনো আবাসন ব্যবস্থা। অর্থাৎ মাত্র ১২ শতাংশ শিক্ষার্থীর রয়েছে হলে থাকার সুবিধা। বিশেষ করে এই অঞ্চলের মানুষজন অপেক্ষাকৃত অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি দারিদ্র্যপ্রবণ। ফলে এখানে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা আবাসিক সংকটে ভোগেন বেশি। তাছাড়া স্থানীয় এলাকাবাসীর হাতে এখানকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেকটাই জিম্মি। বিশেষ করে স্থানীয় বাড়িওয়ালারা যা ইচ্ছা ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে এরকম পরিস্থিতিতে অসহায়। দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে মেস মালিকদের অত্যাচার। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন দুর্ভোগ যেন দেখার কেউ নেই! ফলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অবিরত। মেয়েদের জন্য নির্মাণাধীন হল প্রায় পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে। নেই কোনো সুরাহা। ফলে আবাসিক সংকট চরম আকারে রয়েছে।
হলের ডাইনিংগুলোতে দাম অনুযায়ী মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের রয়েছে অপ্রতুলতা। এছাড়া রয়েছে ক্যাফেটেরিয়ার অস্বাস্থ্যকর খাবার, যা নিজেদের জন্য অভিশাপ হিসেবে দেখছেন শিক্ষার্থীরা।
উত্তরবঙ্গের উচ্চশিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ হওয়া সত্ত্বেও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র—টিএসসি। নেই কোনো অডিটোরিয়াম। যেন ‘নেই’ শব্দের সমার্থক শব্দ বেরোবি। অথচ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে, মুক্তচিন্তার ধারাকে বিকশিত করতে, গবেষণায় এগিয়ে যেতে টিএসসি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ কারণে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর থেকে বেরোবি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে।
বেরোবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো গবেষণা। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গবেষণায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় যদিও পিছিয়ে রয়েছে, তবে আগের থেকে গবেষণা ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে অনেকাংশে। সেটাও নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। আবার গবেষণার ইনস্টিটিউট আছে, সেটাও দীর্ঘদিন ধরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। নেই কোনো রক্ষণাবেক্ষণ। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে গবেষণার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণসঞ্চারের জায়গা। শহরগামী কিংবা অনেক শিক্ষার্থীর আবেগের জায়গা। কিন্তু শিক্ষার্থী অনুপাতে বাসের সংকট, রয়েছে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব। দেখা যায়, বাসের ভেতরে ফ্যান থাকলেও সে ফ্যান ঘুরে না। তাছাড়া এত বছর পরও বাড়েনি বাসের সংখ্যা। অথচ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে। আর এতে শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
বেরোবিতে প্রবেশের মূল ফটক ২ নম্বর গেটে (নির্মাণাধীন) রাস্তা পারাপারের জন্য নেই কোনো ফুটওভার ব্রিজ। প্রায় রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে এখানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয় রাস্তা। অনাকাঙ্ক্ষিত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে এখানে একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সমাবর্তন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের কাছে এই অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবেগের ও মর্যাদার। কিন্তু দেশের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পার হরেও সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কোনো আয়োজন হয়নি।
এই বিষয়ে একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় নবীন হলেও ধীরে ধীরে সারা বাংলাদেশে সুনাম অর্জন করছে। প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তি অনেক। বিদ্যমান সংকটগুলো কেটে যাবে আশা করে তারা বলেন, নির্মাণাধীন স্বাধীনতা স্মারক, ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, শেখ হাসিনা হল, ক্লাসরুম, বাস সংকট, অডিটোরিয়াম, টিএসসি, ক্যাম্পাস বর্ধিতকরণ মন্দির ও গবেষণায় বাজেট বাড়ানো দরকার। বেরোবির উপাচার্য প্রফেসর ড. হাসিবুর রশীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি, চলমান সমস্যা ও সংকটগুলো নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন বলে প্রত্যাশা করেন শিক্ষার্থীরা।